আজ ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’। গত বছরের এই দিন বিশ্বজুড়ে ‘৩৬ জুলাই’ নামেই বেশি পরিচিত। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের এ দিনে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তিলাভ করে। দিনটি কেবল একজন স্বৈরশাসকের পতনের দিনই নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও জনগণের সাহসিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কোটা আন্দোলনঃ
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে, যা পরবর্তীতে "জুলাই বিপ্লব" নামে পরিচিত হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন দ্রুতই ছাত্র-জনতার একটি ব্যাপক গণজাগরণে পরিণত হয়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যারা বিদ্যমান কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়। সরকারের দমননীতি ও গণহত্যার মুখে এই আন্দোলন সরকারের পতনের মাধ্যমে শেষ হয় এবং এটি জাতির দ্বিতীয় স্বাধীনতার নাম ধারণ করে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটঃ
২০১৮ সালে প্রথমবারের মতো কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে ছাত্রসমাজ আন্দোলনে নামলে তা দেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। যদিও সে সময় সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছিল, ২০২৪ সালে হাইকোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে। এই রায়ের পর দেশের শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠনটি আবারও নেতৃত্ব দেয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
বাংলা ব্লকেড ও শিক্ষার্থীদের উপর হামলাঃ
জুলাই মাসে আন্দোলন “বাংলা ব্লকেড” নামে পরিচিত দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ সময় আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে। রংপুরে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়। দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সরকার কারফিউ জারি এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
গণহত্যাঃ
কোটা সংস্কার আন্দোলনে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। সেদিন সারা দেশে ৬ জন নিহতের খবর পাওয়া যায়। এরপর থেকে নিহতের মিছিল জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হন। যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। প্রায় ২০ হাজার আহত হন। সরকারি আংশিক হিসাবে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৮৩৪ জন নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং মিশনের তথ্য মতে, নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ১৪০০ জন। আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা (এসিএলইডি) থেকে তথ্য ব্যবহার করে বিবিসি বিশ্লেষণমূলক মৃত্যুর একটি তথ্য দিয়েছে। সেই তথ্য অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৩৮৪ জন।
১৯৫২, ’৬৯, ’৯০-এর সঙ্গে যুক্ত হলো ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানও। তবে ’২৪-এর এই আন্দোলন মৃত্যু, প্রতিরোধ ও বিস্তারের দিক দিয়ে ছাপিয়ে গেছে আগের সব অভ্যুত্থানকে। অতীতের মতো এবারও সামনে ছিলেন শিক্ষার্থীরা, তবে এবার নেতৃত্ব দিয়েছে এক নতুন প্রজন্ম—‘জেনারেশন জি’। শুধু রাজপথ নয়, তাদের লড়াই হয়েছে অনলাইনেও—ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের প্রধান হাতিয়ার।
এক দফা দাবিঃ
দমন-পীড়নের মুখে আন্দোলনকারীরা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করে। “দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ” স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়। ছাত্র ও জনতার অভূতপূর্ব অংশগ্রহণে এ আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়।
একদিন এগিয়ে "মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ঘোষনা আসে ৪ আগস্টঃ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ছিল মূলত ৬ আগস্টে। তবে, ৪ আগস্ট বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দেওয়া এক বার্তায় তা একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
'মার্চ টু ঢাকা' কর্মসুচি ঠেকাতে কঠোর হয় সরকারঃ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে। একই সঙ্গে তিন দিনের (৫, ৬ ও ৭ আগস্ট) সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এ অবস্থায় ৫ আগস্ট সকাল থেকে রাজধানীর সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। মূল সড়কে মানুষের চলাচল ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঠেকাতে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগের দিন (৪ আগস্ট) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দুই দফায় উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনার পতনের বিষয়ে পরদিন (৫ আগস্ট) সকাল থেকেই সেনাবাহিনী অবগত ছিল। কিন্তু পুলিশ জানত না বলে সরকারকে রক্ষা করতে তখনো সর্বাত্মকভাবে মাঠে ছিল।
ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) যা ঘটেছিলঃ
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ঢাকার উদ্দেশে জনস্রোত শুরু হয়। উত্তরা-আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গি থেকে হেঁটেই ছাত্র-জনতার স্রোত সামনে এগিয়ে আসতে থাকে। উত্তরায় আটকাতে না পেরে খিলক্ষেত ও বনানী এলাকায় পুলিশ চেষ্টা করে জনস্রোত ঠেকানোর জন্য। তবে, সেটা সম্ভব হয়নি।
কারণ, ৫ আগস্ট সকালে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যরা মূলত দাঁড়িয়েছিলেন। আগের রাতে সরকারের করা পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা অর্পিত ভূমিকা পালন করেননি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সাক্ষ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সেনা মোতায়েন করা হয়নি। আরেকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, বিজিবি প্রতি ঘণ্টায় বিভিন্ন প্রবেশপথ দিয়ে প্রায় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বিক্ষোভকারীকে ঢুকতে দিয়েছে, যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল।
আওয়ামীলীগ সরকারের পতনঃ
টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কড়া কারফিউ উপেক্ষা করে গত বছরের ৫ আগস্ট পূর্বঘোষিত ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি সফল করতে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা অভিমুখে পদযাত্রা করে। দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নেমে আসে রাজপথে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি, টিয়ারশেলসহ সব ধরনের বাধা উপেক্ষা করে হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন তারা। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ, টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহারের মধ্যেও আন্দোলন থেমে থাকেনি। অবশেষে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ্জামান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। জনগণের চাপ ও গণহত্যার বিচারের ভয়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। আনন্দে উদ্বেলিত হাজার হাজার মানুষ গণভবনে ঢুকে আনন্দ-উল্লাস করতে থাকে। শুধু গণভবনই নয়, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর অসংখ্য উত্তেজিত জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও জাতীয় সংসদেও ঢুকে পড়ে। দেশের প্রতিটি শহর-উপশহর, পাড়া-মহল্লায় আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।
উপসংহারঃ
জুলাই বিপ্লব ২০২৪ বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও জনগণের ন্যায্য অধিকারের একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এ গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করে, জনগণের সম্মিলিত শক্তি কোনো স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে না। এ বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক যুগের সূচনা হয়। ৩৬ জুলাইয়ের বিজয় কেবল অতীতের একটি ঘটনার স্মরণ নয়। এটি ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তার ভিত্তি, যেখানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থান ছিল জাতীয় ঐক্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন—যেখানে ছাত্র, শ্রমিক, পেশাজীবী, প্রবাসী, সাংবাদিক, শিল্পী ও রাজনৈতিক দলসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্রে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে। সেই ঐক্য এখন আরও প্রয়োজন। রাষ্ট্রকে নতুন ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হলে আমাদের সবাইকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই চেতনাকে জারি রাখা এবং তাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। কারণ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই অন্তর্বর্তী সরকারকে যারা তথাকথিত ‘সুশীলতার’ মুখোশে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চায়, তারা মূলত সেই পুরনো ফ্যাসিবাদী শাসনের দোসর। অতীতে যারা গুম, দমন, বাকস্বাধীনতা হরণে নীরব থেকেছে, তারাই আজ গণতন্ত্রের নতুন যাত্রার পথে বিঘ্ন ঘটাতে চায়। এদের চিহ্নিত করতে হবে, জনগণের আশার রাজনীতিকে হাইজ্যাক করতে দেওয়া যাবে না।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী সকলের সমন্বিত নৈতিক প্রত্যয় এবং সক্রিয় অংশগ্রহণই আগামী দিনের বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে এক ন্যায়নিষ্ঠ, সাংবিধানিক এবং টেকসই রাষ্ট্রব্যবস্থার পথে। এখনই সময় ৩৬ জুলাই এর আকাঙ্ক্ষাকে বহন করা, রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের মালিকানাকে নিশ্চিত করা এবং ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ থাকা।