বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ছায়াঘেরা শান্ত গাছতলায় কিছু শিক্ষার্থী বসেছিল। হঠাৎ জিজ্ঞেস করা হলো-“বাবা মানে কী?” কেউ একটু চুপ করল, কেউ আকাশের দিকে তাকাল, কেউ শুধু নীরব রইল। কিন্তু চোখেমুখে আবেগের কাঁপন ধরা পড়ল স্পষ্ট। এত ভালোবাসার মানুষটিকে জড়িয়ে ধরে “ভালোবাসি, বাবা”-এই কথাটুকু বলার সুযোগ যেন কখনোই হয়ে ওঠে না।
বাবা-এই শব্দটি শুধু একটি সম্পর্ক নয়, বরং এক নির্ভরতার প্রতীক, এক নিঃশব্দ আশ্রয়। চোখের আড়ালে থাকলেও হৃদয়ের গহীনে তিনি সর্বদা বিরাজমান। বাকৃবির সবুজে মোড়া ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ানো হাজারো শিক্ষার্থীর অন্তরে বাবারা আছেন নিঃশব্দ প্রেরণা হয়ে। সেই গভীর অনুভবের প্রতিধ্বনিতেই কাটল আরও একটি বিশ্ব বাবা দিবস।
বাকৃবি শিক্ষার্থীরা বাবাকে নিয়ে মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা না বলা কথাগুলো কেউ তুলে ধরেছেন গদ্যে, কেউবা কবিতায়। প্রকাশ করেছেন ভালোবাসা, মুগ্ধতা, স্মৃতি ও না-বলা কথাগুলো।
“তোমাকে দেখে আমি শিখেছি সততা”
ফারজানা আক্তার
তৃতীয় বর্ষ, কৃষি অনুষদ
সেশন: ২০২৩–২৪
বাবা, তুমি হয়তো প্রতিদিন "ভালোবাসি" বলো না,
তবে তোমার প্রতিটা কাজ আমায় বুঝিয়ে দেয়—তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তোমাকে দেখে আমি শিখেছি সততা, শিখেছি ন্যায়ের পথে জীবন গড়তে। আমি তোমার মতো হবার চেষ্টা করি। আমার অনেক শখ আমার আব্বু মতো হবো আমি। শুধু একটা দিন নয়, প্রতিটা দিনই তোমার ভালোবাসা ও ত্যাগে আমার জীবন পূর্ণ।
“আমি পালিয়েছিলাম, আব্বা পথ গড়েছিলেন”
মো. মুন্তাসির মাহমুদ
স্নাতকোত্তর, অ্যাকুয়াকালচার বিভাগ
শিক্ষাবর্ষ: ২০২৪–২৫
"প্রথম স্কুলে যাবার দিন আমি খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, বাবা নিশ্চয়ই বকবে। কিন্তু আশ্চর্যভাবে তিনি কিছুই বলেননি। পরদিন শুনলাম তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিজেই কেজি স্কুল খুলবেন। আমার সেই একদিনের স্কুলভীতিই ছিল বাবার জীবনের এক মাইলফলক সিদ্ধান্তের কারণ। এখন বুঝি, আমি পালিয়েছিলাম আর আব্বা পথ গড়েছিলেন। শক্ত মুখের আড়ালে বাবাই ছিল সবচেয়ে নরম হৃদয়।"
বাবারা কাঁদেন না, কারণ পরিবারের কেউ যেন না ভেঙে পড়ে। তাঁরা ভেঙে পড়লেও সেটা হয় আড়ালে, নিভৃতে। তাঁরা চুপ থাকেন, যাতে ঘরটা শান্ত থাকে। তাঁরা বলেন না, “ভালোবাসি,” কারণ তাঁরা সেটা হাজারটি কাজে বলে দেন।
কিছুদিন আগেই ছিলো বাবা দিবস। হয়তো আমরা এখনও বাবাকে “ধন্যবাদ” বলিনি, “ভালোবাসি” বলিনি। তবে সময় পেরিয়ে গেলে এসব শব্দ ব্যথা হয়ে ফিরে আসে মনে।
“পৃথিবীর সকল বাবাকে উৎসর্গ করে আমার এই কবিতা”
সানন্দ সিংহ রায়
মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ
শিক্ষাবর্ষ: ২০২৪–২৫
আমার বাবা মারা গেছেন ২০১১ সালে। বাবাকে কল্পনা করেই লিখেছি কবিতাটা। কবিতাটা আমি পৃথিবীর সকল বাবাকে উৎসর্গ করেই লিখেছি।
“বাবা মানে বটবৃক্ষ, বাবা মানেই আশ্বাস,
প্রতিক্ষণে মনে করি, তুমি আমার নিঃশ্বাস।
আঁধার পথে জ্বালাও আলো, দেখাও সঠিক পথ,
তোমার ছায়ায় নির্ভয়ে চলে সন্তানের জীবন-রথ।
বাবা মানে নির্ভরতা, বাবা মানেই অনুপ্রেরণা,
শত কষ্ট করেও তুমি ঘুচাও মোদের যন্ত্রণা।
আমার বাবা আমার কাছে সকল রাজার রাজা,
বাবা, তুমি ধরিয়ে দিও মোরে সফলতার ধ্বজা।
বাবা মানে সাহস, বাবা মানেই বিশ্বাস,
সন্তানের তরে তুমি অফুরন্ত ভালোবাসার আকাশ।
বাবা, তুমি থাকলে পাশে, স্বপ্ন বুনতে পারি,
তোমার দেখানো পথে হাঁটবো—এই সংকল্প করি।”
“বাবা, আপনাকে অনেক ভালোবাসি”
সাবরীনা আক্তার
চতুর্থ বর্ষ, পশুপালন অনুষদ
শিক্ষাবর্ষ: ২০২০–২১
২০১৮ সালে বাবার ওপেন হার্ট সার্জারির পর যখন তিনি বাড়ি ফিরে এসে আবার আমাকে 'বাবু' বলে ডাকেন, অজানা কারণে চোখ বেয়ে পানি নেমে এসেছিল। বলতে পারিনি তখনও-‘আপনাকে অনেক ভালোবাসি।’
আমার বাবাকে আমি বলতে চাই- জীবনভর আপনার ত্যাগ, ভালোবাসা ও দিকনির্দেশনায় আপনার বাবু আজ এই অবস্থায় এসেছে। আপনি যেন দীর্ঘায়ু হন, সুস্থ থাকেন, আর আমি যেন আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারি। বাবা, আপনার বাবু আপনাকে অনেক ভালোবাসে।
“বাবা তুমি আমার জীবনের আশ্রয়”
মো. রাইসুল করিম রিজভী
প্রথম বর্ষ, কৃষি অনুষদ
আব্বু, মুখ ফুটে কখনও বলোনি তুমি আমায় কতখানি ভালোবাসো? কিন্তু আমার প্রতি তোমার যত্ন, আমার ছোট বিপদে তোমার আকাশ সমান চিন্তা, ছোট অর্জনে খুশিতে চোখ ভেজানো-সব কিছুতেই বোঝা যায় কি বিশাল আকাশ পরিমান ভালোবাসো আমায়। আমি আজ যা হয়েছি, তার পেছনে রয়েছে তোমার নিঃস্বার্থ পরিশ্রম। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আমি যেন তোমার মতোই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে তোমার সেবা করতে পারি।
“বাবার না-দেখা ত্যাগেই লুকিয়ে থাকে তার পুরো জীবন”
রাদ্বীনা খাতুন মুগ্ধ
তৃতীয় বর্ষ, কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ
আমার কাছে বাবা মানে নিরব ভালোবাসা—কথায় নয়, কাজে যার প্রকাশ। চাওয়ার আগেই তিনি বুঝে যান আমাদের প্রয়োজন। নিজের সব ইচ্ছেকে আড়াল করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটান। তাঁর কাঁধেই আমাদের ভরসা, তাঁর ছায়াতেই গড়ে ওঠে আমাদের ছোট্ট দুনিয়া। বাইরে থেকে যতই কঠিন মনে হোক, ভিতরে তিনি এক নরম পাহাড়। আমরা ভুল করলে শাসন করেন ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসায় কোনো ঘাটতি রাখেন না। তিনি বলেন কম, কিন্তু করেন অনেক বেশি-এই না-দেখা ত্যাগেই লুকিয়ে থাকে তার পুরো জীবন। আমার জীবনের সেই নীরব, নিরলস নায়কের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।”
বাবারা হয়তো মুখে বলেন না ‘ভালোবাসি’, কিন্তু তাঁদের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আত্মত্যাগ সন্তানের জীবনে ভালোবাসার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুবাদ হয়ে থাকে। বাবা দিবসে বাকৃবি শিক্ষার্থীদের এই অনুভূতিগুলো সেই ভালোবাসারই শ্রদ্ধাস্পদ স্বীকৃতি।