ভোলায় পানিতে ডুবে ৮ মাসে ১শ’ ২০ শিশুর মৃত্যু

শরীফ হোসাইন প্রকাশিত: ১২ আগস্ট , ২০২৫ ১৪:৫৮ আপডেট: ১২ আগস্ট , ২০২৫ ১৪:৫৮ পিএম
ভোলায় পানিতে ডুবে ৮ মাসে ১শ’ ২০ শিশুর মৃত্যু

 ভোলায় গত ৮ মাসে পানিতে ডুবে ১শ’ ২০ জন শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে পরিবারের অসচেতনতায় প্রতি বছরই পানিতে ডুবে প্রায় ২শ’র মত শিশুর মৃত্যু হয়। তবে চলতি বছরে ৮ মাসেই ১শ’ ২০ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চরফ্যাশন উপজেলায় ৩৭ জন, মনপুরা উপজেলায় ৮ জন, তজুমদ্দিন উপজেলায় ১০ জন, লালমোহন উপজেলায় ১২ জন, দৌলতখান উপজেলায় ৩ জন, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় ২৪ জন এবং ভোলা সদর উপজেলায় ২৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গত শনিবার দুপুরে ভোলা সদর হাসপাতালে দেখা মিলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের। একমাত্র কন্যা শিশু রাইসা মনিকে (৮) হারিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি করে কাঁদছেন রাইসার বাবা রাসেল হাওলাদার ও তার স্ত্রী। রাইসা তার দাদির সঙ্গে গোসল করতে গিয়ে পুকুরে পানিতে ডুবে মারা যান।
নিহত শিশু রাইসার চাচা ফরহাদ জানান, গত শনিবার দুপুর ১টার দিকে শিশু রাইসা ও তার চাচাতো ভাই রাহাত তাদের দাদির সঙ্গে বাড়ির পাশে একটি পুকুরে গোসল করতে যান। পরে তাদের দাদির গোসল শেষে রাইসা ও রাহাতকে ঘরে আসতে বলে তিনি ঘরে ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ পর তাদের আসতে দেরি হওয়ায় পুনরায় পুকুর ঘাটে গিয়ে শিশু রাহাতকে পানিতে ভেসতে দেখেন। তাৎক্ষনিক রাহাতকে উদ্ধার করলেও রাইসাকে পাওয়া যায় পুকুরের ঘাটলার নিচে ডুবন্ত অবস্থায়। পরে দু’জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক রাইসাকে মৃত ঘোষণা করেন এবং রাহাতকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি চরফ্যাশন উপজেলায়। এই উপজেলায় বিস্তীর্ণ জনপদে রয়েছে অসংখ্য পুকুর আর খাল বিল। যার ফলে এখানে প্রায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত মার্চ মাসে এই উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নে নানা বাড়িতে বেড়াতে এসে রেদোয়ান নামের ৫ বছর বয়সী এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। শিশুটির বাবা প্রবাসী রুবেল হোসেন আজও ছেলেকে হারানোর শোক বুকে নিয়ে প্রবাস জীবন কাটাচ্ছেন। মা মুক্তা বেগম একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মাঝে মাঝে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠেন।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নে খাদিজা নামের ৩ বছর বয়সী এক শিশু পুকুরের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। শিশুটির মা জাহানারা বেগম জানান, আমার মাইয়্যা ডা আর নাই, ওরে কইলাম মা তুমি পুস্কুনিত (পুকুরে) যাইয়ো না, কিন্তু মাইয়্যা ডা কোন ফাঁকে গেল গা টের পাইলাম না। বাড়ির উডানে (আঙ্গিনা) দেখলাম খেলে, এরপর আর দেখি নাই, চাইয়্যা দেখি মাইয়্যা আমার পুস্কুনির (পুকুর) পানিতে ভাসে।
সুত্রমতে, বর্ষা মৌসূম আসলেই জেলার নদ-নদী ও পুকুরগুলো পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। শিশুরা পানিতে খেলা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় পানির পাশে অনায়াসে গিয়ে এরকম দূর্ঘটনার শিকার হন। শিশু মৃত্যুর প্রতিকারে, পরিবারের সচেতনতাই মূল দায়িত্ব বলে মনে করছেন সচেতন মহল। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ শিশুই সকাল ১০ টাকা থেকে দুপুর ২ টার মধ্যে পানিতে ডুবে মারা যায়। কারণ এসময় শিশুদের মায়েরা ঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এই সুযোগে শিশুরা বাড়ির আঙ্গিনায় খেলা করার সময় অসাবধানতাবশত পানিতে ডুবে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সহযোগীতায় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অর্থায়নে সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে শিশুদের সাঁতার শিখানো হচ্ছে। শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতার সুবিধা প্রদান (আইসিবিসি) প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর মো: হারুন অর রশির জানান, 'পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে ভোলায় ৫০টি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার শিশুকে সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই প্রকল্পে জেলায় ১০০ জন প্রশিক্ষকের মাধ্যমে ৬ বছরে থেকে ১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শিখানো হচ্ছে। আশা করি এই প্রকল্পের মাধ্যমে কিছুটা হলেও শিশু মৃত্যুর হার কামনো যাবে।
ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের লোকাল সুইমিং ইনস্ট্রাক্টর (এলএসআই) মো: আল আমিন বলেন, আমাদের প্রতিটি সাঁতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সপ্তাহে ৫০ জন শিশুকে সাঁতার শিখানো হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিটি শিশু সাঁতার শিখে নিজেকে আতœরক্ষা করতে পারে। এতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার অনেকটা কমে আসবে।
ভোলার সিভিল সার্জন ডা: মো: মনিরুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের ৮ মাসে পানিতে ডুবে ১শ’ ২০ জন শিশু মৃত্যু হয়েছে। যা অত্যান্ত দুঃখজনক। শিশু মৃত্যু রোধে শিশুর মায়েদের আরও সচেতন হতে হবে। বাড়ির পাশের পুকুর থাকলে তাতে জাল বা বাঁশ দিয়ে বেড়া দিয়ে দিতে হবে, যাতে শিশুরা পুকুরে কাছে যেতে না পারে। এছাড়াও শিশুদের পর্যাপ্ত সময় দিয়ে তাদের প্রতি নজর রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ শিশুই সকাল ১০ টাকা থেকে দুপুর ২ টার মধ্যে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়। এসময় মায়েরা ঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন। যার ফলে শিশুরা খেলা করার সময় অসাবধানতাবশত পানিতে ডুবে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়। এই সময়টায় শিশুদের প্রতি খেয়াল রেখে শিশুদের মায়েদের কাছে রাখতে হবে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু রোধে পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। এছাড়াও, শিশুদের ৪/৫ বছর বয়স হওয়ার সাথে সাথে তাদের সাঁতার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। যাতে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে পারে।

এই বিভাগের আরোও খবর

Logo